ইন্ডাকশন চুলার আদ্যোপান্ত

ইন্ডাকশন চুলার আদ্যোপান্ত

ইন্ডাকশন চুলা


রন্ধনসম্পর্কীয় প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান বিশ্বে, ইন্ডাকশন রান্না একটি গেম-চেঞ্জার হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে।

অনেকে প্রশ্ন করেন, ম্যাজিক চুলায় চারশো টাকায় সারা মাসের রান্না’ সত্যি কি হয়?

ম্যাজিক চুলা ব্যবহারের অভিজ্ঞতাসহ বিস্তারিত জানাতে পারেন?



আমার ইন্ডাকশন কাহিনী


দুর্গম এলাকায় রান্নার উপকরণ হল মূলত জঙ্গলের কাঠ বা লাকড়ি

আজ থেকে কুড়ি বছর আগে তখন কেউ ইন্ডাক্সন চুলার নামও শোনেনি এদেশে। তখন এক পাহাড়ি এলাকায় থাকতাম চাকরীর সুবাদে। সেখানে গ্যাস দুর্মূল্য। সবাই লাকড়ীর চুলা আর কেউ গোপনে হিটার ব্যবহার করতো।

দুটোরই সমস্যা ভীষন, পাকা ঘরে লাকড়ী চুলাওয়ালাদের রান্নাঘর থেকে বারান্দার দেয়াল কালো হয়ে থাকতো। হিটার ব্যবহার আইনত নিষিদ্ধ, তাই ব্যবহার হতো চোরা লাইনে, নতুবা অনেক বিল আসতো। সে চোরা লাইন চেক করতে নিয়মিত পিডিবির লোকজন হানা দিতো যখন তখন।

আমার নতুন সংসার। বউ শহরের মেয়ে, বেচারী লাকড়ির চুলা বা হিটার কোনটাই ব্যবহার জানতো না। সিলিন্ডার গ্যাসও তখন সহজলভ্য ছিল না পাহাড়ে।

আমার আমেরিকা ফেরত এক বন্ধু কথাচ্ছলে বলে ছিলো, সেখানে ইলেক্ট্রিক চুলা আছে, ব্যবহারও বৈধ, বিলও খুব কম। কিন্তু বিশ্বাস হলোনা আমার।



একাধিক ইন্ডাক্সন চুলা এক সেটিং এ

যাহোক, এর পরে শহরে শীতকালীন এক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় স্ত্রী ঘুরতে নিয়ে গেলো আমাকে। সেখানে কিয়াম বা ভালো কোম্পানির ইন্ডাকসন চুলা দেখলাম প্রথম কিন্তু অনেক দাম, প্রায় সেসময় পচিশ হাজার টাকা চাইলো। এতো সামর্থ্যও আমার নেই, আবার সব পাত্রে রান্না ও হবেনা স্পেশাল পাত্র লাগবে জেনে কিছুটা হতাশ।

আমি নতুন জিনিস কিনতে আমি ভয় না পেলেও স্ত্রী খুব ভয় পেতো। অনেক দোকান ঘুরে শুধু চাইনিজে লেখা ব্যবহার বিধি আছে এমন একটা চাইনিজ চুলা সাড়ে তিনহাজারে কিনে ফেললাম স্ত্রীর প্রবল আপত্তি সত্বেও। চুলার সাথে বইপত্র সব চাইনিজ ভাষা। তবুও তারা একটা পাতলা কড়াই স্যাম্পল হিসেবে বিক্রি করলো।

ঘরে এসে দেখলাম পরিচিত কেউই এ জিনিস চোখেও দেখেনি। আমি বিদ্যুত সংযোগ দিয়ে একের পর এক রান্নার পাত্রে জল দিয়ে সুইচ অন করে, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখি কোন পরিবর্তন নেই জলের। আমার স্ত্রী ততই কঠোর চোখে আমার দিকে তাকায় আর বলে, চার হাজার টাকা নষ্ট করলে।

শেষ পর্যন্ত এক স্টীলের বোওলে জল দিয়ে সুইচ দিতেই একমিনিটেে জল ফুটতে শুরু করলো। আমি জেনে গেলাম এর রহস্য।

তারপর দিন বাজার ঘুরে বেশ তিনচারটা ইন্ডাক্সন বেইজ কারী প্যান কিনে আনলাম। তখনো এর নাম কিন্তু জানিনা। কিছু দোকানদারকে বুঝিয়ে বলতে উনারা বুঝিয়ে দিলেন।

তারপর খুব স্বচ্ছন্দে তা ব্যবহার করেছিলাম। যেহেতু জনগন এটাকে হিটারই মনে করে তাই লুকিয়ে ব্যবহার করতাম।

বাঙালিকে চিনতাম বলে কাউকে সেটার কথা বলিনি, শুধু এক উপজাতীয় মহিলাকে বলেছিলাম। সে কিনেও বেশ স্বচ্ছন্দেে ব্যবহার শিখে নিলো। রান্না শেষে একটা গামছা দিয়ে ঢেকে রাখলে কারো সাধ্য নেই এটা চেনার।

প্রায় দশ বছর সার্ভিস দিয়েছিলো চুলাটি। একদিন এমন দুধ উথলে পড়লো সেই ইন্ডাক্সন চুলা নস্ট হলো। ততদিনে সবাই চিনে ফেলেছে এই ফেরোম্যাগনেটিক কুকারটিকে। দামও এখন নাগালের মধ্যে। এরপর রেডিয়েশন চুলা আসলো। সেটাতে যেকোন পাত্রে রান্না করা যায়।তবে শুধু ভয়, সেটার গরম লাল টকটকে উত্তপ্ত অংশ, বাচ্চাদের হাত লাগলে পুড়ে শেষ যাবে।তাই কেনার পরও দুষ্ট বাচ্চাটার ভয়ে ব্যবহার করিনি। নতুন বাংলাদেশি মেড ইন্ডাক্সন কিনেছিলাম।


ইন্ডাকশন হিট কী

ইন্ডাকশন হিটিং হল ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশনের মাধ্যমে ধাতু বা সেমি-কন্ডাক্টরকে গরম করার প্রক্রিয়া যা কয়েলের মধ্যে একটি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করে যা ইস্পাত, তামা, পিতল, গ্রাফাইটকে গরম করতে এবং গলিয়ে দিতে পারে।

ইন্ডাকশন হিটিং প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল তাপ সঞ্চালনের মাধ্যমে বাহ্যিক তাপ উৎসের পরিবর্তে বস্তুর ভিতরেই তাপ উৎপন্ন হয়। এইভাবে বস্তুগুলি খুব দ্রুত উত্তপ্ত হতে পারে। উপরন্তু, কোন বাহ্যিক যোগাযোগের প্রয়োজন নেই, যা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে যেখানে দূষণ একটি সমস্যা।

ইন্ডাকশন হিটিং অনেক শিল্প প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়, যেমন ধাতুবিদ্যায় তাপ চিকিত্সা, সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে এবং অবাধ্য ধাতুগুলিকে গলানোর জন্য যার জন্য খুব উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। এটি ইন্ডাকশন বা আনয়ন কুকটপগুলিতেও ব্যবহৃত হয়।



আনয়ন রান্নার সুবিধা

তাহলে, আনয়ন রান্নার সুবিধা কী এবং কেন এটি এত জনপ্রিয়? এখানে এমন কিছু জিনিস রয়েছে যা আনয়ন রান্নাকে এত দুর্দান্ত করে তোলে।

  • ১. দ্রুত রান্নার সময়: ইন্ডাকশন রান্নার অন্যতম প্রধান সুবিধা হল এর গতি এবং দক্ষতা। ইন্ডাকশন কুকটপ গ্যাস বা বৈদ্যুতিক চুলার তুলনায় অনেক দ্রুত গরম হয়, যা আপনাকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রান্না শুরু করতে দেয়। আনয়ন রান্নার তাপও আরও সমানভাবে কুকওয়্যার জুড়ে বিতরণ করা হয়, যার ফলে দ্রুত এবং আরও বেশি রান্না হয়।
  • ২. শক্তি দক্ষতা: প্রথাগত রান্নার পদ্ধতির তুলনায় আনয়ন রান্না আরও শক্তি-দক্ষ। যেহেতু রান্নার পাত্রে সরাসরি তাপ উৎপন্ন হয়, তাই তাপের ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। এর মানে হল কম শক্তির অপচয় হয়, ফলে শক্তির বিল কম হয়।
  • ৩. পোড়া এবং আগুনের কম ঝুঁকি: বিভিন্ন কারণে গ্যাস বা বৈদ্যুতিক চুলার চেয়ে ইন্ডাকশন কুকটপ নিরাপদ বলে মনে করা হয়। যেহেতু কুকটপ নিজেই গরম হয় না, তাই পোড়া বা দুর্ঘটনাজনিত আগুনের ঝুঁকি কম থাকে। আপনার বাড়িতে ছোট বাচ্চা বা পোষা প্রাণী থাকলে এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
  • ইন্ডাকশন কুকটপগুলিতে অন্তর্নির্মিত সুরক্ষা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন স্বয়ংক্রিয় শাট-অফ এবং প্যান সনাক্তকরণ। কুকটপ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায় যখন এটি সনাক্ত করে যে কুকওয়্যারটি সরানো হয়েছে বা রান্নার সময় শেষ হয়ে গেছে। এটি দুর্ঘটনাক্রমে কুকটপ ছেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করে।
  • ৪. উন্নত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ: ইন্ডাকশন রান্না সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের অফার করে, যা আপনাকে আরও নির্ভুলতার সাথে রান্না করতে দেয়। গ্যাস বা বৈদ্যুতিক চুলার বিপরীতে, যা তাপ সামঞ্জস্য করতে কিছু সময় নিতে পারে, ইন্ডাকশন কুকটপগুলি তাত্ক্ষণিকভাবে তাপমাত্রার সেটিংসের পরিবর্তনে সাড়া দেয়। এটি আপনার খাবারকে সিদ্ধ করা, ভাজতে বা সিদ্ধ করা সহজ করে তোলে


উচ্চ-কার্যকারিতা গ্লাস-সিরামিক পৃষ্ঠের মাধ্যমে সরবরাহ করা অত্যন্ত দ্রুত গরম এবং সুনির্দিষ্ট তাপ নিয়ন্ত্রণের কারণে গৃহবধূ ও শেফরা ইন্ডাকশন রান্না পছন্দ করে। এছাড়াও, ইন্ডাকশন টেকনোলজি প্যানটিকে উষ্ণ করে, পৃষ্ঠ বা আশেপাশের এলাকা নয়, তাই খুব কম তাপ ঘরে প্রবেশ করে।

কোন আগুন নেই ধোঁয়া ও নেই, পাত্র গরম হয়না, বিল কম, টাইম ও টেম্পারেচার লকার আছে, শুধু স্টীলের ফ্ল্যাট পাত্র লাগে। চা থেকে শুরু করে বিরিয়ানী পর্যন্ত সব রান্না সম্ভব, যদি সিলিকন কোটেড স্টীল বেজ কারি কুকার জোটে।

কিছু লোক উদ্বিগ্ন যে প্যান গরম করার জন্য ব্যবহৃত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের কারণে ইন্ডাকশন স্টোভ অস্বাস্থ্যকর, কিন্তু সাধারণভাবে, আপনাকে ইন্ডাকশন স্টোভ থেকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড (EMFs) নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। এগুলি অ-আয়নাইজিং এবং সরাসরি ডিএনএ বা কোষের ক্ষতি করে না। তারা মধ্যবর্তী ফ্রিকোয়েন্সি ইএমএফগুলি বন্ধ করে দেয়।

বিদ্যুৎ খরচ


এই চুলা কি প্রচুর বিদ্যুৎ ব্যবহার করে?# ইন্ডাকশন কুকারের বিদ্যুত খরচ বিভিন্ন কারণের উপর নির্ভর করে, যেমন রেট করা পাওয়ার এবং অপারেশনাল ঘন্টা। গড়ে, এটি প্রতি ঘন্টায় প্রায় ১৭০০ ওয়াট থেকে ৩০০০ ওয়াট খরচ করে।


ইন্ডাকশন কুকিং মেকানিজম

একটি ইন্ডাকশন হিটারে একটি ইলেক্ট্রোম্যাগনেট এবং একটি ইলেকট্রনিক অসিলেটর থাকে যা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটের মধ্য দিয়ে একটি উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সি অল্টারনেটিং কারেন্ট (AC) পাস করে। দ্রুত পরিবর্তনশীল চৌম্বক ক্ষেত্র বস্তুর মধ্যে প্রবেশ করে, কন্ডাক্টরের ভিতরে বৈদ্যুতিক স্রোত তৈরি করে যাকে এডি কারেন্ট বলা হয়। এডি স্রোত উপাদানের প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং জুল গরম করে তা উত্তপ্ত করে।

ফেরোম্যাগনেটিক এবং ফেরিম্যাগনেটিক পদার্থে, যেমন লোহার, তাপও চৌম্বকীয় হিস্টেরেসিস ক্ষতি দ্বারা উত্পন্ন হয়। ইন্ডাকশন গরম করার জন্য ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক প্রবাহের ফ্রিকোয়েন্সি বস্তুর আকার, উপাদানের ধরন, কাপলিং (কাজের কুণ্ডলী এবং উত্তপ্ত করা বস্তুর মধ্যে), এবং অনুপ্রবেশ গভীরতার উপর নির্ভর করে।

ইন্ডাকশন চুলায় কীভাবে রান্না হয়!


চিত্র: ইন্ডাকশন কুকারের মেকানিজম।

ইন্ডাক্সন চুলায় রান্না হয় মুলত এর ভিতরে থাকা ফেরোম্যাগনেটিক কয়েলের কারনে। যাতে বিদ্যুত চালনা করলে eddy currents উৎপন্ন হয় যা পাত্রের রেজিস্ট্যান্স এর ফলে তেরী হওয়া তাপ স্টীলের পাত্রের সংলগ্ন অংশে কাজ করে। এতেই রান্নার কাজ হয়। যদি পাত্রে পানি বা তেল না থাকে বা শুকিয়ে যায় তবে এটা অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে খাবার পুড়ে যাওয়ার ভয় কম। বর্তমানে খুব চমৎকার সব ইন্ডাকশন কুকার আছে।

সমস্যা হলো, হার্টে পেসমেকার বা ইমপ্লান্টেশন করা রুগীদের সমস্যা হতে পারে। ঘরের অন্যান্য ইলেকট্রনিকস কাছাকাছি রাখলে ক্ষতি হতে পারে।

কিন্তু ইন্ডাক্সন কুকার এসোসিয়েশন এর মতে, এই জিনিসের রেডিয়েশন মাত্রা খুবই কম যা মাইক্রোওয়েভের সমান। চুলা থেকে একফুটের বেশি দুরত্বে এর রেডিয়েশন যায় না। তবুও এসব রুগীরা একফুট দুরে থেকে কাজ করতে পারে।


« Previous কোন জনপ্রিয় খাবারগুলো পুষ্টিহীন?


ইন্ডাকশন চুলায় কীভাবে রান্না করবেন

ইন্ডাকশন বা আবেশন রান্নার তাপমাত্রা সেটিংস বোঝা

আপনার ইন্ডাকশন কুকটপ থেকে সর্বাধিক সুবিধা পেতে, তাপমাত্রা সেটিংস বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। ইন্ডাকশন রান্নার জন্য তাপমাত্রা পরিসীমা নেভিগেট করতে আপনাকে সাহায্য করার জন্য এখানে একটি সাধারণ নির্দেশিকা রয়েছে:

  • কম তাপ (100°F - 200°F): চকোলেট, মাখন গলানোর জন্য বা খাবার গরম রাখার জন্য আদর্শ৷
  • মাঝারি তাপ (200°F - 300°F): সস, স্যুপ বা ধীর রান্নার জন্য উপযুক্ত।
  • মাঝারি-উচ্চ তাপ (300°F - 400°F): শাকসবজি ভাজানোর জন্য বা মাংস সিদ্ধ করার জন্য উপযুক্ত।
  • উচ্চ তাপ (400°F - 500°F): ফুটন্ত জল, নাড়া-ভাজা, বা গভীর-ভাজার জন্য দুর্দান্ত।

প্রেসার কুকারে রান্না করা কী স্বাস্থ্যকর Next »

সুত্রঃInduction Home Page

মন্তব্যসমূহ