জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার মাঝে পার্থক্য কী

জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার মাঝে পার্থক্য কী

জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার মাঝে পার্থক্য


জ্ঞান, প্রজ্ঞা এর পার্থক্য বিশাল হলেও অন্তদৃষ্টি সম্পন্নরা অন্ধকারে ও দেখেন!


জ্ঞান কী

জ্ঞান বলতে বুঝায় কোনো কিছু সম্পর্কে সম্যক ধারণা করার মতো শক্তি বা বোধশক্তি। অভিজ্ঞতা বা শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত তত্ব , তথ্য এবং দক্ষতা; একটি বিষয়ের তাত্ত্বিক বা ব্যবহারিক বোঝাপড়া।


জ্ঞান কোন একটি সত্য বা পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা দ্বারা অর্জিত সচেতনতা বা পরিচিতিও হতে পারে। সেটি একটি বিজ্ঞান, শিল্প বা কৌশল বোঝা বা পরিচিত হওয়া।


প্রজ্ঞা জ্ঞানের উপর নির্মিত। তার মানে আপনি জ্ঞানী এবং প্রজ্ঞাবান উভয়ই হতে পারেন, তবে আপনি জ্ঞানী না হয়ে প্রজ্ঞাবান হতে পারবেন না।


আপনি জ্ঞানী হওয়ার অর্থ এই নয় যে আপনি প্রজ্ঞাবান। যদিও আপনার ছাত্ররা অন্যরকম অনুভব করতে পারে।


জ্ঞান যুক্তি এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতাকে তীক্ষ্ণ করে। জ্ঞানের ভিত্তি মস্তিষ্ককে মসৃণ এবং কাজ করতে সহায়তা করে। আমরা জ্ঞানের শক্তিতে আরও স্মার্ট হয়ে উঠি এবং আরও সহজে সমস্যার সমাধান করি।


* দৈনন্দিন জীবনের - জ্ঞান প্রতিদিনের ঘটনাগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ এবং দরকারী।



প্রজ্ঞা কী



সব জ্ঞান ই সঠিক নয়। প্রজ্ঞা হল সেই জ্ঞানের কোন দিকগুলি সত্য, সঠিক, দীর্ঘস্থায়ী এবং আপনার জীবনে প্রযোজ্য তা বোঝার এবং বিচার করার ক্ষমতা।


এটি সেই জ্ঞানকে জীবনের বৃহত্তর পরিকল্পনায় প্রয়োগ করার ক্ষমতা।  এটি আরও গভীর;  অর্থ বা কারণ জানা;  কেন কিছু হয় এবং আপনার জীবনে এর অর্থ কী তা জানার বিষয়ে।


প্রজ্ঞা বলতে বুঝায় জ্ঞানকে হৃদয়ঙ্গম করে, নিজের অভিজ্ঞতা দ্বারা এর সুফলকে, বাস্তবে প্রয়োগ করার মতো শক্তি।


বুদ্ধিমত্তা হিসাবে "জ্ঞান অর্জন এবং প্রয়োগ করার ক্ষমতা হল প্রজ্ঞা।


প্রজ্ঞা প্রকৃষ্ট জ্ঞান , যার দ্বারা মঙ্গল সাধিত হয়।একজন চোরেরও জ্ঞান আছে।  কিন্তু জেনেও সে চুরি করে, ধরা পড়ে ,মারও খায়। সুতরাং এই লোকের জ্ঞান থাকলেও প্রজ্ঞা নাই।


প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি কর্মে সাধু হবেন, চিন্তায় সৎ হবেন; কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তি ভন্ড বাটপার হতেও পারেন। কি করে লোক ঠকাতে হয় তিনি জানেন।


ডেসটিনির রফিকুল আমিন, ইভ্যালির রাসেল কিংবা হলমার্কের এমডি এরা  ঠগবাজ জ্ঞানী বাটপার। কিন্তু প্রজ্ঞার অভাবে সকলে জেলখাটছে।



জ্ঞান ও প্রজ্ঞা
পেশাগত অভিজ্ঞতা

আমি এবার আমার পেশাগত দৃষ্টিকোন থেকে প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব।


বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনীতিক ওবায়দুল কাদের সাহেব ভয়ংকর হার্ট এটাক নিয়ে বিএসএমএমইউ তে ভর্তি হয়েছিলেন গত বছর।


তাঁকে সেখানে একনজর দেখেছিলাম। সেখানকার চিকিৎসকরা তাঁকে প্রয়োজন মতো চিকিৎসাও দেন।


প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে উপমহাদেশের বিখ্যাত হার্ট সার্জন শ্রদ্ধেয় ডাঃ দেবী শেঠি ভারত থেকে বাংলাদেশ উড়ে আসেন ওনার জন্য।


উনার পরামর্শ ক্রমে কাদের সাহেবকে বাইপাস সার্জারির জন্য সিঙ্গাপুর নেয়া হয় ( যেখানে এদেশের মন্ত্রীরা প্রায়ই যান)।


ডাঃ দেবী শেঠি ও বিএসএমএমইউর চিকিৎসকরা এ ধরনের সার্জারি নিজেরা প্রায়ই করে থাকেন। তাঁরা সকলেই জ্ঞানী।


কিন্তু স্থান, কাল পাত্র ও পরিবেশ বিবেচনায় তাঁরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যা তাদের প্রজ্ঞা। শ্রদ্ধেয় দেবী শেঠীর এই সিদ্ধান্ত ই হলো প্রজ্ঞা।


তাদের প্রজ্ঞার কারনে কাদের সাহেব এখনো দলকে সফল নেতৃত্ব দিচ্ছেন।


ডাঃ দেবী শেঠি নিজস্ব টিম ও সেটআপ এর বাইরে নতুন পরিবেশে অপারেশন করে হয়ত সফল নাও হতে পারতেন।


আমরা গত বছর দেখেছিলাম রাজধানীর বিখ্যাত হাসপাতালে একজন চলচ্চিত্র পরিচালকের মায়ের খারাপ কিডনির অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে তার ভালো কিডনিটিও কেটে ফেলা হয়।


ডান দিকের পা ভেঙ্গে দিল্লির একটি নামী হাসাপাতালে ২৪ বছর বয়সী এক ভারতীয় নাগরিকের ডান পায়ে অস্ত্রোপচার না করে তার ভাল বাম পায়ে অস্ত্রপচার করা হয়।


ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের প্রথম আর্টিকেলে বলা হয়েছে, একজন ভালো সার্জন জানেন কীভাবে অপারেশন করতে হবে, আরো ভালো সার্জন জানেন কখন অপারেশন করতে হবে, কিন্তু শ্রেষ্ঠ সার্জন জানেন অপারেশন কখন না করাটাই মঙ্গল, এটিই সার্জনের প্রজ্ঞা।


এদেশের অভিজ্ঞ সার্জন মাত্র উপরোক্ত প্রবাদটি মুখস্থ করেন কিন্তু প্রজ্ঞার অভাবে কর্মক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করেন না।


অর্থলোভে রাত আড়াইটা তিনটা পর্যন্ত প্র্যাকটিস করে, ক্লান্ত হয়ে ঘরে এসে ঘুমিয়ে, তারপর দিন অপারেশনে নেমে পড়েন।


আপকামিং অপারেশন নিয়ে যথেষ্ট স্টাডি না করে এসিস্ট্যান্ট এর হাতে ছেড়ে দেন সবকিছু। তারপর বিপত্তি ঘটে।


"ভুল চিকিৎসায় ,,,, " পত্রিকার শিরোনাম প্রায় দেখতে হয় আমাদের দেশে জ্ঞানী কিন্তু প্রজ্ঞাহীন সার্জনের অভাবে। অথচ তাঁদের জ্ঞানের অভাব নেই। যথেষ্ট ট্রেনিংও পেয়েছেন জীবনে।


তাই শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করা গেলেও প্রজ্ঞা অর্জন করা যায় না। প্রজ্ঞা অর্জন করতে সাধনা লাগে।


ইংরেজি তে প্রায় বলা হয়, টম্যাটো একটি ফল , এই জানাটা হলো জ্ঞান কিন্তু ফলের সালাদে টম্যাটো না দেয়াটাই হলো প্রজ্ঞা।


কোন জিনিসের ভাল ও মন্দ জানাটা জ্ঞান কিন্তু কোনটি সঠিক বা ভুল সেটা জানাটা প্রজ্ঞা।


“সিগারেটে অনেক ক্ষতি রয়েছে” জানাটা জ্ঞান আর প্রজ্ঞা হলো, “সিগারেট থেকে নিজেকে দূরে রাখতে সমর্থ হওয়া”।


একজন জ্ঞানী মানুষ অনেক কিছু জানতে পারেন, কিন্তু তিনি প্রজ্ঞাবান নাও হতে পারেন।


যদিও প্রজ্ঞাবান হবার প্রথম শর্ত জ্ঞানী হওয়া। একজন মানুষ অনেক জ্ঞানী হয়ে প্রজ্ঞাবান না হয়ে বিবেকহীনও হতে পারেন।



জ্ঞানের পরিক্রমা

উপাত্ত বা ডেটা➡️ তথ্য ➡️ জ্ঞান ➡️ প্রজ্ঞা➡️দ্যুতি


ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদ বা ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়, ড: এপিজে কালাম উনাদের কথা আমরা সকলে জেনেছি। উনারা জ্ঞান ও প্রজ্ঞার চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে বসে থাকেন নি।


জ্ঞানের দ্যুতি ছড়াতে তাঁদের জাতিকেও সেবা দিয়ে গেছেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে।



অন্তদৃষ্টি কী

জ্ঞানের দ্যুতি ই হলো অন্তদৃষ্টি। অন্তর্দৃষ্টি হল জানার গভীরতম স্তর এবং  জীবনের জন্য সবচেয়ে অর্থবহ।


অন্তর্দৃষ্টি হল জীবন, জ্ঞান, প্রজ্ঞার একটি গভীর এবং স্পষ্ট উপলব্ধি।


এটি জ্ঞানের অন্তর্নিহিত প্রকৃতি এবং প্রজ্ঞার সারমর্মকে উপলব্ধি করছে। অন্তর্দৃষ্টি হ'ল  জীবনের একটি সত্য উপলব্ধি এবং কীভাবে জিনিসগুলি একে অপরের সাথে জড়িত তার বড় চিত্র।


জ্ঞানের মূলনীতিগুলো

জ্ঞান তথ্য নয়, যদিও তথ্য ব্যবস্থাপনা নীতিগুলি জ্ঞানে প্রয়োগ করা যেতে পারে।


জ্ঞান হল অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ, অন্তর্দৃষ্টি, শিক্ষার সমষ্টি।

১, জ্ঞান একটি মূল্যবান সম্পদ

জ্ঞান হল এমন একটি সম্পদ যা জনসেবাগুলির দক্ষ এবং কার্যকর সরবরাহের জন্য মৌলিক।

২, জ্ঞানের উন্নতির জন্য সঠিক পরিবেশ প্রয়োজন

জ্ঞানের উন্নতির জন্য উপযুক্ত আচরণ এবং সংস্কৃতির প্রয়োজন, যা নেতা এবং ব্যক্তিদের দ্বারা একইভাবে লালনপালিত এবং গ্রহণ করা হয়।

৩, যেখানে প্রয়োজন এবং সম্ভব সেখানে জ্ঞান ধারণ করা হয়

জ্ঞানের শিক্ষা যা সদস্যদের মাথায় স্পষ্টভাবে ধারণ করা হয় তা স্পষ্ট, নথিভুক্ত জ্ঞানে পরিণত হয়।

৪,জ্ঞান অবাধে চাওয়া এবং ভাগ করা হয়

জ্ঞান এমন একটি সম্পদ যা ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যকলাপ থেকে বিকাশ লাভ করে – যাকে একত্রিত করে সাংগঠনিক জ্ঞান গঠন করা যেতে পারে।

৫, পুনঃব্যবহারের মাধ্যমে জ্ঞানের মূল্য বৃদ্ধি পায়

জ্ঞানের মূল্য পুনরায় ব্যবহার করে বহুগুণ করা যেতে পারে।

৬, জ্ঞান ব্যক্তিগত শিক্ষার ভিত্তি তৈরী করে

জ্ঞান হল শিক্ষার ভিত্তি, শ্রেণীকক্ষ এবং কর্মক্ষেত্র উভয় ভিত্তিক।

৭, জ্ঞান সাংগঠনিক শিক্ষার ভিত্তি তৈরী করে

এই প্রেক্ষাপটে সাংগঠনিক শিক্ষা হল সংগঠনের ব্যক্তিদের সম্মিলিত জ্ঞান থেকে উপকৃত হওয়ার ক্ষমতা।



জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং অন্তদৃষ্টি

জ্ঞান যদি তথ্য হয়, প্রজ্ঞা হল সেই জ্ঞানের উপলব্ধি এবং প্রয়োগ আর অন্তর্দৃষ্টি হল একটি সত্যের অন্তর্নিহিত সারাংশ সম্পর্কে সচেতনতা।


দুঃখজনকভাবে আমরা আজীবন জ্ঞান লাভ করতে পারি, তবুও এর মধ্যে প্রজ্ঞা দেখতে পাই না। আমরা জ্ঞানী হতে পারি, কিন্তু প্রজ্ঞা দেখাতে মিস করি।


জ্ঞান পরিমাপ করছে যে একটি মরুভূমির পথ 12.4 মাইল দীর্ঘ। প্রজ্ঞা পর্যাপ্ত জল প্যাকিং করা হয় বাড়ানোর জন্য। অন্তর্দৃষ্টি  প্রতি 6 মাইল এ একটি লেমনেড  তৈরি করছে সতেজ থাকতে।


জ্ঞান হল আপনার অর্থ, বাজেট, ব্যয়, সঞ্চয় কীভাবে পরিচালনা করবেন তা জানা। প্রজ্ঞা হল অর্থ কীভাবে আপনার জীবন এবং আপনার ভবিষ্যতের গুণমানকে প্রভাবিত করে তা বোঝা।


অন্তর্দৃষ্টি উপলব্ধি করছে যে অর্থ কেবল ব্যবহার করার একটি হাতিয়ার, এর উপযোগিতা ছাড়া এর কোন অন্তর্নিহিত অর্থ নেই।


জ্ঞান হল কিভাবে আঁকা শিখতে হয় এবং সেই দক্ষতা ব্যবহার করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়।


প্রজ্ঞা চিত্রকলার মাধ্যমে আপনার আবেগকে প্রকাশ করছে এবং বোঝাচ্ছে যে শিল্প হল যোগাযোগের একটি রূপ যা অন্যদের জীবনকে স্পর্শ করে।


ধন্যবাদ।


সূত্র,


নেচার সায়েন্স,  https://www.nationalarchives.gov.uk/information-management/manage-information/planning/knowledge-principles/


ক্রিস্টোফার রেইস

মন্তব্যসমূহ