চার পাখার ফ্যান
সাধারণত, ফ্যান ব্যবহার করা হয় গরমের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। তবে আমেরিকার ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্যরকম। সে দেশে ফ্যান মূলত ব্যবহার করাই হয় এয়ার কন্ডিশনারের বাতাসকে সহজাতভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। তিনটি ব্লেডের কারণে অনেক জোরালো বাতাস হয়, চারটি ব্লেড থাকলে তা হয় না। এই একটি ব্লেড বেশি থাকার কারণে বাতাস অনেক হালকাভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে এয়ার কন্ডিশনারের বাতাস পরিমিতভাবে পুরো ঘরে চলাচল করে।
অন্যদিকে, আমাদের দেশ তথা উপমহাদেশে ফ্যানের ব্যবহার কেবলই জোরালো বাতাস তৈরির জন্য। এয়ার কন্ডিশনারের বাতাস ছড়ানোর প্রয়োজনীয়তা এখানে সেভাবে নেই বললেই চলে। এ কারণে এখানে তিন ব্লেডওয়ালা ফ্যানই তৈরি করা হয়, যা আমরা সবসময় দেখে অভ্যস্ত।
ফ্যানের জন্মঃ
এই যান্ত্রিক পাখার জন্ম সুদূর আমেরিকায়, ১৮৬০ এর দশকে। তবে তখন বিদ্যুতের মাধ্যমে পাখা ঘুরতো না, পানি দিয়ে সেটা চলতো।
পানির স্রোতটাকে কাজে লাগিয়ে এই কাজটি করা হত। একই পানির স্রোতকে কাজে লাগিয়ে অনেকগুলো ফ্যান ঘুরানো যেত বলে সে সময় এটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে খরচ একটু বেশি ছিল বলে শুধুমাত্র অফিস আদালত, রেস্টুরেন্ট এসব জায়গায় এটি ব্যবহার করা হতো। এরপর এলো বিদ্যুৎ চালিত ফ্যান, ১৮৮২ সালে। একজন জার্মান-আমেরিকান যান্ত্রিক প্রকৌশলী এবং উদ্ভাবক যিনি বৈদ্যুতিক ভাস্বর বাতি, সেলাই মেশিন এবং অন্যান্য ব্যবহারের জন্য বৈদ্যুতিক মোটর এবং সিলিং ফ্যান সহ বেশ কয়েকটি মার্কিন পেটেন্ট ধারণ করেছিলেন। ডাইহেল ছিলেন টমাস এডিসনের সমসাময়িক এবং তার উদ্ভাবনের কারণে এডিসন তার ভাস্বর বাল্বের দাম কমাতে বাধ্য হন।। তখন সবাই সিলিং ফ্যানকে তার ফিলিপ ফ্যান নামেই নামকরণ করে। সেই বিখ্যাত ফিলিপস কোম্পানি এখনো সেই ফ্যান তৈরী করে তবে এখনো আমেরিকার দক্ষিণ দিকের কিছু কিছু এলাকায় সেই প্রাচীনকালের ফ্যান পাওয়া যায়। তখন দুই ব্লেডের ফ্যান বেশি জনপ্রিয় ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে চার ব্লেডের ফ্যানের প্রচলন শুরু হয়। আর সেই সময়েই প্রথম আমেরিকা থেকে বাইরের বিশ্বে ফ্যান বাজারজাত করা হয়। সারা বিশ্ব হয়ে যায় ফ্যানের ফ্যান!!
আমার চার পাখার ফ্যান
সাধারন মানুষের মতো ইলেকট্রনিকস বা ইলেকট্রিকস এর কিছু না জানলেও আগ্রহবশত চারবছর আগে চারপাখার একখানা ফ্যান কিনেছিলাম । আমার উদ্দেশ্য ছিলো চারপাখা ও লাইটযুক্ত ফ্যান কেনা ।
অনলাইনে, মুভিতে, বিজ্ঞাপনে এমন ফ্যান অনেক দেখেছি। বলতে পারেন ফ্যানের ছবি দেখেই ফ্যান হয়ে যাওয়া। আমরা যে বাতিগুলো ব্যবহার করি, ওসব খাড়া দেয়ালে গেঁথে বা প্যাচিঁয়ে লাগানো হয়। সুন্দর মুখে ব্রণ উঠলে যেমন দেখায়, সুন্দর দেয়ালে বাল্বগুলোও তেমন। ছোট ঘরে, যা চোখের জন্য পীড়াদায়ক, চামড়ার জন্য ক্ষতিকর ও ঘরের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্যও কিছুটা দায়ী এ বাতিগুলো ।
তাই আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে মনে হলো, বাতিটা যদি উপর থেকে দেয়া যায়
এবং ফ্যানের মাঝখানের অংশটায় থাকে, ফ্যান ঘুরবে কিন্তু মাঝের
অংশটি স্থির থাকবে। এতে বাতির আলো সুর্য্যমামার মতো উপর থেকে
আসবে আবার ফ্যানের বাতাসে আলোর উষ্ণতাও কিঞ্চিত কমে যাবে।
ভারতীয়
হাভেল বা খৈতান এর মতো অসাধারণ উদ্ভাবনী কোম্পানি বা বাংলাদেশের
আরএফএলের মতো কোম্পানির জন্যও এটা বানানো ডালভাত ।
যাহোক,
সেরকম লাইটওয়ালা ফ্যান কিনতে রাইফেলস ক্লাবে ( চট্টগ্রামে
ফ্যানের "তীর্থস্থান" ) স্বস্ত্রীক গেলাম। পেলাম ও একটা বিদেশী
কিন্তু দাম শুনে ২৩০ ভোল্টের কারেন্ট খেলাম। ঐ এক ফ্যানের দাম
দিয়ে চারটি ভালো ফ্যান কেনা যায় ( এছাড়া স্ত্রীর যুক্তিতে ঘরে
বাতি এমনিতেই আছে, আলগা বাতির কি দরকার!)
আমার
স্ত্রীর মেজাজের ভয়ে তিনরুমের জন্য তিনটি তিনপাঙ্খাওয়ালা বাংলা
ফ্যান কেনা হলো। শুধু আমার ইচ্ছায় একটি চারপাখার ফ্যান কিনলাম।
জানলাম, বিয়ের পর বাঙালী পুরুষের ইচ্ছে বলে কিছুই নাই, সবটাই
কম্প্রোমাইজ।
বৈশাখের তীব্র তাপদাহে তিনপাখাওয়ালা
ফ্যানগুলো যখন সজোরে ঘুরছে, আমি চারপাখার ফ্যানের নীচে দরদর করে
ঘামছি।
যখন বাঙালি পেটভরে মাংসভাত খেয়ে শরীরের
অভ্যন্তরিণ তাপে উত্তপ্ত হয়ে " ফ্যান ছাড়, ফ্যান ছাড় " করে
চিৎকার দিয়ে উঠবে, লোডশেডিং হাজির হবেই। আইপিএস টেবিল ফ্যান ই
ভরসা তখন, সেটাও ফুরিয়ে গেলে, বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সে-ই "
তালপাখা" ।
বড় কুটুম্ব ( সম্বন্ধী) দাওয়াতে এসে,
চারপাখার স্বল্প- বাতাস খেয়েই, আমার বুদ্ধি- স্বল্পতার কথা স্মরণ
করালেন স্ত্রী কে। শালীরাও বললো, পুরুষজাতি কেনাকাটায় যে
নির্বোধ, মেয়েরা তা আগে থেকেই জানে।
মনে রাখবেন যে বড় রিচার্জেবল ফ্যান বেছে নেওয়ার বিরুদ্ধে এটি সর্বোত্তম পরামর্শ দেওয়া হয় কারণ সেগুলি কষ্টকর হতে পারে। হ্যাঁ, ছোট রিচার্জেবল ফ্যানের চেয়ে ভারী ব্যাটারির বড় রিচার্জেবল ফ্যানের সাথে তার ব্যাটারির আয়ুও কম হবে।
যাহোক,
ইজ্জতহানির ভয়ে, দৌড়ে স্ট্যান্ডবাই হিসেবে স্ট্যান্ড - ফ্যান
কিনে আনলাম, পাকিস্তানি " জিএফসি " সেই তীর্থস্থান থেকে । সেটায়
এমন ঝড়ো হাওয়ার মতো বাতাস, শোয়েব আখতার বল হাতে ছুটে আসছে যেনো।
পত্রিকার পাতা পড়া যাচ্ছেনা, উড়ছে । বিদ্যুৎ বিলও টর্নেডো গতিতে
আসছে।
তখনই ভাবলাম কিছু কেনার আগে, কেন কিনবো, আদৌ
প্রয়োজন কিনা, সেটা আমাদের দেশ, আবহাওয়া ও গৃহের বিদ্যুত লাইনের
উপোযোগি কিনা তা জেনেই কেনা উচিত।
সেক্সি ফ্যান!
যাহোক, পাখা বেশি হলেই বাতাস বেশি হবে না, বরং অতিরিক্ত পাখার ওজন ফ্যানের মোটরকে শ্লথ করে দেবে, এটা বুঝলাম তবে ধরা খাওয়ার পরে। উঃ আমেরিকায় গরমকালে ফ্যান চলে মুলতঃ এসির বাতাসকে ছড়িয়ে দিতে বা শীতকালে রিভার্স সুইচের মাধ্যমে উল্টোদিকেও ফ্যান চলে সেখানে। এতে রুমহিটারের উত্তাপকে উপরে সরিয়ে নিতে সুবিধা হয় । তাই চার বা পাঁচ পাখার ফ্যান সেখানে জনপ্রিয়। আর তিনপাখার ফ্যান গরম প্রধান দেশগুলোতে জনপ্রিয় সজোরে ঘরের বাতাস বের করার জন্য।
এক শীতের সকালে দু'লিটারি ইলেকট্রিক কেটলি চালু করে আমার স্ত্রী
মেইন লাইনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আর গত বৈশাখের গরমে, ঘুষ বা
জিডিপি বাড়ায়, এই বিল্ডিংয়ের বড়লোক বাসিন্দারা এত বেশি এসি
লাগালো যে বিল্ডিংয়ের ট্রান্সফরমার ই বার্স্ট হয়ে গেলো।
তারপর
এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু থেকে শিখলাম, বিদ্যুৎ দুটো মুলনীতি মেনে
চলে। একটি " ভোল্টেজ" অন্যটি "ফ্রিকোয়েন্সী'।
সমগ্র
ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়ায় বিদ্যুৎ ২৩০ ভোল্ট ও ৫০ হার্টজ কিন্তু উঃ
আমেরিকায় ১১০ ভোল্ট ও ৬০ হার্টজ এ চলে। ঘরে সরবরাহের বিদ্যুৎ
লাইনকে আমরা বলি কারেন্ট লাইন, ব্রিটিশরা " দ্যা মেইনস"
মার্কিনরা " ইউটিলিটি পাওয়ার " ও কানাডিয়ানরা " হাইড্রো লাইন"
বলে ( তাদের >৫০% উৎপাদিত বিদ্যুৎ জল বিদ্যুৎ বলে) ।
তাই
এদেশের কোন ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র বা প্লাগ উঃ আমেরিকায় ব্যবহারের
আগে তাদের ইউটিলিটি লাইন জেনে নেয়া উচিত।
এত
মহাশক্তিধর যুক্তরাষ্ট্র ইরান কে ভয় না করে উঃ কোরিয়া কে ভয় করার
কারন ও ঐ বিদ্যুৎ । ভয়ংকর " ইএমপি" বা ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস
বোমা আছে কোরিয়ার । এই বৈদ্যুতিক বোমায় যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ
ইলেকট্রনিকস ও ইলেকট্রিক ডিভাইস অকেজো হয়ে যেতে পারে মুহুর্তে ।
সস্তা "মানব- বোমা" বা "সুইসাইডাল বোম্ব" এ পশ্চিমারা আতংকিত নয়
আর।
তাই সিরীয়াকে ঘাটানো যতটা সহজ, কোরিয়াকে ততটা নয়।
মন্তব্যসমূহ
আমার দেশ ভারতে গত ২০১৫ সালে এ্যাটমবার্গ টেকনোলজিস নামে এক নতুন কোম্পানির আবির্ভাব ঘটে ৷ তারা বৈদ্যুতিক পাখার গোটা কনসেপ্টটাই পালটে দেয় ৷ যদিও এটা তারা আবিস্কার করেনি অবশ্যই ৷ সেটা হলো BLDC মোটর ওয়ালা ফ্যান ৷ সিলিং ও অন্য সব রকমই ৷ যেমন টেবল ফ্যান, স্ট্যান্ড ফ্যান, ওয়াল ফ্যান, একজস্ট ফ্যান, ইত্যাদি ৷ সাধারন 48 ইঞ্চি বা 1200 মি.মি. স্যুইপের সাধারন ফ্যানের ফুল স্পীডে পাওয়ার খরচ হয় মাত্র 28 ওয়াট ! আর সাধারনত যে তিন নং স্পীডে থাকলে, যে পজিশনে বেশিরভাগ সময়েই থাকে, খরচ মাত্র 15 ওয়াটেরও কম ! অবিশ্বাস্য , কিন্তু সত্য ৷ আমি বাড়িতে প্যথমে চারটে পুরনো ফ্যানকে রিটায়ার করিয়ে এই ফ্যান লাগানোর পরে ইলেক্ট্রিক বিল উল্লেখযোগ্য রকম কমে গেলো ৷ উল্লসিত হয়ে আরো দুটো ওয়াল ফ্যান ও আরো তিনটে নতুন মডেলের ফ্যান নিলাম ৷ এখন গরমের সময় বিদ্যুৎ খরচ নেমে গেছে মাসে ₹1500/- থেকে ₹750/--₹800/- র মধ্যে ৷ অভাবনীয় ব্যাপার আরকি ! আরও একটা মজার ও খুবই উল্লেখযোগ্য ব্যাপার বলা হয়নি যে এই ফ্যানগুলো সবই রিমোট কন্ট্রোলে অপারেট করা যায় ৷ এতে সুইচ অন/অফ করা থেকে স্পীড বাড়ানো-কমানো ছাড়াও অফ টাইমার ও স্মার্ট পাওয়ার সেভিং মোডও আছে ৷ সেই সেটিং এ দিলে পাখার স্পীড প্রতি দু ঘন্টা অন্তর অন্তর এক ধাপ করে নেমে শেষ এক নম্বর স্পীডে চলে আসে এবং পাওয়ার সেভিংও হতে থাকে ৷ এক নম্বর পজিশনে এই ফ্যান খরচ করে মাত্র পাঁচ ওয়াট !