মুসলিমরা ভারতে হাজার বছর শাসন করার পরও হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ কেন?
প্রথমেই হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত কে শ্রদ্ধা জানাই এইজন্য যে মধ্যপ্রাচ্যের নোংরা জঙ্গিবাদ ভারতের কারণেই আফগানিস্তান, পাকিস্তান ডিঙিয়ে বাংলাদেশে আসতে পারেনি। ভারতের উদার গণতন্ত্রের দেয়াল শুধু বাংলাদেশ নয় পূর্ব এশিয়াকেও রক্ষা করছে। ভারতের এমন অবদান কে চীনের নেতারাও শ্রদ্ধার চোখে দেখে থাকেন।
মুসলিম শাসকদের ভারত অভিযান
তুর্কি শাসক গজনীর সুলতান মাহমুদ এবং ঘুড়ির শাসক মোহাম্মদ ঘুরী আনুমানিক ৭২৭ থেকে ১০০০ সাল পর্যন্ত ১৭ বার ভারত আক্রমণ করে। সুলতান মাহমুদ খলিফার কাছ থেকে উপাধি নেওয়ার সময় ' ইসলাম' ধর্ম প্রচারের শপথ নেন। বলতে গেলে , এদের ভারত আক্রমনের প্রকৃত কারণ মনে হয়- অর্থ লাভ: সমকালীন হিন্দু মন্দির গুলি প্রচুর ধনরত্ন দ্বারা পূর্ণ ছিল সেই মন্দির গুলি থেকে মূর্তিসহ স্বর্ণমুদ্রা লুট ই ছিল উদ্দেশ্য। ইসলামের প্রচার উপেক্ষিত ছিল।
দিল্লি সালতানাত
দিল্লি সালতানাত, একটি ইসলামি সাম্রাজ্য যা মধ্যযুগীয় ভারতের সময়কালে উপমহাদেশের বিশাল অংশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল, ৩২০ বছর (১২০৬-১৫২৬)। দিল্লি সালতানাত ক্রমানুসারে: মামলুক রাজবংশ (১২০৬-১২৯০), খলজি রাজবংশ (১২৯০-১৩২০), তুঘলক রাজবংশ (১৩২০-১৪১৪), সাইয়িদ রাজবংশ (১৪১৪-১৪৫১), এবং লোদি রাজবংশ (১৪৫১- ১৫২৬)।
দিল্লি সালতানাত মূলত তুর্কি দাস-জেনারেলদের দ্বারা শাসিত।
মুঘল শাসন
মুঘল সাম্রাজ্য (১৫২৬-১৮৫৮), মুঘল (বা মোগল) সাম্রাজ্য ১৬ এবং ১৭ শতকে ভারত ও পাকিস্তানের অধিকাংশ শাসন করেছিল। "মুঘল" শব্দটি "মঙ্গোল" শব্দের ভুল উচ্চারণ থেকে এসেছে, কিন্তু ভারতের মুঘলরা বেশিরভাগই জাতিগত তুর্কি ছিল মঙ্গোলীয় নয়। যাইহোক, বাবর (১৪৮৩-১৫৩০), প্রথম মুঘল সম্রাট, মোঙ্গল শাসক চিঙ্গিস খানের সাথে তার রক্তের রেখা খুঁজে পেতে পারেন। মুঘলরা ছিল মুসলমান যারা একটি বৃহৎ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ শাসন করত। সম্রাটরা সকলেই নিজেদের মুসলিম বলে পরিচয় দেন, পিতৃতান্ত্রিকভাবে মধ্য এশিয়ার সুন্নি তুর্কি বিজয়ী তৈমুর (১৩৩৬-১৪০৫, ওরফে টেমেরলেন) থেকে এসেছেন। প্রতিটি স্বতন্ত্র মুঘল সম্রাট তার নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস এবং অভিব্যক্তি গড়ে তুলেছিলেন যা তিনি সত্যিকার ইসলাম বলে মনে করতেন।
মুসলিমদের ভারত শাসনের সারাংশ
রিচার্ড ইটন দেখিয়েছেন, পূর্ব বাংলায় ইসলামের বৃহৎ প্রসারণ বহু শতাব্দী ধরে আরববণিক দের সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া। জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহার নয়। অন্যদিকে, দক্ষিণ ভারতের মালাবার এবং করোমন্ডেল উপকূলে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশাল বসতি ভারত মহাসাগরের বাণিজ্য নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। আরব, পারস্য এবং অন্যান্য মুসলিম বণিকরা উপকূলীয় শহরে বসতি স্থাপন করে এবং নতুন সাংস্কৃতিক রূপের উদ্ভবের জন্য "স্থানীয়দের" সাথে মিশে যায়।
ইসলাম প্রচারে আরবদের যত আগ্রহ ছিল, পারস্য ও তুর্কিদের তার চেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল রাজ্য বিস্তারে, ও লুটপাটে। একই কারণে তুর্কিরা মুসলিম অধ্যাষিত ইরান ও সুলতান অধিকৃৎ ভারত আক্রমণ করে। ইরানের নাদির শাহ মোগল ভারত আক্রমণ করে।
ধর্মীয় বিষয়ে মতের বৈচিত্র্য এবং মাঝে মাঝে দ্বন্দ্ব এবং উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে, শাসকরা এমন অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন (যাকে আধুনিক রাজনৈতিক ভাষায় "বহুত্ববাদী" বা "ধর্মনিরপেক্ষ" শাসক হিসাবে উল্লেখ করা হবে) যেগুলি প্রায়শই নির্দিষ্ট সুন্নি মুসলিম মহলের সর্বাত্মক বক্তব্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। এরা সুন্নি হানাফি শাসক হলেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সমর্থিত একচেটিয়া বা অভিন্ন ইসলাম কখনোই উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি এসব শাসক রা। সবচেয়ে প্রভাবশালী সম্রাট আকবর নিজে ধর্ম নিরপেক্ষ শাসক ছিলেন। তার মন্ত্রীসভা ও সেনাপতিরা স্থানীয় ধর্মবিশ্বাসের লোক ছিলেন। যদি শাসক কর্তৃক ইসলাম কে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া হত তবে আমরা অন্যকিছু দেখতে পেতাম।ভারতে ইসলাম এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম যার অনুসারী শিখ, বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি ভারতীয় ধর্মাবলম্বীদের থেকে বেশি । প্রায় পঞ্চাশ কোটি মুসলিম আছেন উপমহাদেশে যা বিশ্ব মুসলিমের এক তৃতীয়াংশ ও সর্বাধিক মুসলিম অধ্যুষিত দেশের মর্যাদা পায় ভারত। বাস্তবে এসব মুসলিমদের নিজস্ব কোন জঙ্গি বা জিহাদি সংগঠন নেই। শুধু ব্যর্থতা ভারতের মুসলিমরা একত্রিত নয়, যেমনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদীরা দেশটিতে সংখ্যালঘু হয়েও সেই দেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে।যেসব সংগঠন ভারত বা বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা সব মধ্যপ্রাচ্যের টাকায় প্রতিপালিত , স্থানীয় নয় কোনভাবেই। মধ্যপ্রাচ্য ব্যতীত এই পৃথিবী মোটামুটি শান্তিময়। ভারতীয় মুসলিমরা ভারতীয় উদার গণতন্ত্র উপভোগ না করে পাকিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকিয়ে থাকে।
মধ্যপ্রাচ্যের ও দুরপ্রাচ্যের মাঝে ভারত ই একমাত্র দেশ (দেয়াল) যারা মধ্যপ্রাচ্যের ব্যর্থ মৌলবাদ হতে পূর্ব এশিয়াকে রক্ষা করছে। নতুবা মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ হত্যাকারী এসব জঙ্গিবাদ বাংলাদেশ সহ পূর্ব এশিয়ার বর্তমান অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ধ্বংস করে দিত।
মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা পুরোটা মুসলিমিকরন করা হয়েছে বহু যুগ হলো কিন্তু ভারত কেন মুসলিমিকরণ হলো না এই আক্ষেপ অনেকের । ব্রিটিশরা দুইশত বছর ভারত শাসনের পরেও সেখানে খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী হাতে গোনা কেন? স্পেন একদা মুসলিম শাসনে থাকার পরও সেখানে মুসলিমদের সংখ্যা এত কম কেন? সে তুলনায় ভারতে মুসলিমদের সংখ্যা আশাতীত নয় কি?
গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপক মুসলিমিকরণ হলেও জনগণের শিক্ষা ও মৌলিক মানবাধিকার এর কোন উন্নতি এতদিন হয়নি । নারীরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত অনেকদেশে। তাদের আত্মিক তেমন কোন উন্নতি হয় নি যুগের পর যুগ মুসলিম শাসনে থাকার পরও । সেই তুলনায় বাংলাদেশ , দ: ও পূর্ব এশিয়ার শিক্ষার হার, নারী শিক্ষা ও মানবাধিকার অনেক বেশি সুরক্ষিত।
মধ্যপ্রাচ্যের বেশকিছু জঙ্গি সংগঠন চায় নারীরা বিদ্যালয়ে যাবেনা, পাকিস্তানেও তাই। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মধ্যপ্রাচ্যে খাদ্য সঙ্কট আছে, চাষবাসহীন প্রান্তরগুলো অরক্ষিত । এক ইসরাইল ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশ মোট খাদ্যের অর্ধেকও উৎপন্ন করতে পারে না। ধর্মযুদ্ধের নামে লড়াই জিইয়ে রেখে সাধারণ মানুষকে বাধ্য করা হচ্ছে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে ভাগ্য অন্বেষণে। তেল , খেজুর ও আফিম ব্যতীত আর কোন সম্পদ না থাকায় তেলক্ষেত্রগুলোর দখল নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমনের পটভূমিও তাই। অতিরিক্ত তেল নির্ভরতার ফলে এখন তেলের দামও পড়তির দিকে।
অসংখ্য মতবাদের জন্ম হচ্ছে সেখানে , ওয়াহাবি, হানাফী, সালাফি,তালেবানি , ইত্যাদির বাম্পার ফলন সেখানে। পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে একদল মুসলিম আরেকদল মুসলিম এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। ভারত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলে দ: এশিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের নষ্ট জঙ্গিবাদ আরো ভালো ভাবে জাঁকিয়ে বসত। ফলে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনেই এর মত দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নতি থেমে যেত।
যাহোক, ভারতীয় ধর্মবিশ্বাসগুলোর আধ্যাত্মিক উপাদান থাকায় এখানে কিছু শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে। ভারতের মুসলিম শাসকরা চাইলে মধ্যপ্রাচ্যের মত ভারতকে মুসলিমিকরণ করতে পারত । উপমহাদেশের পশ্চিম ও পূর্ব দিকে মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও দিল্লি , উত্তর প্রদেশে তুলনামূলক কম মুসলিমের উপস্থিতি প্রমান করে মুসলিম শাসকরা ধর্ম প্রচারে কোন জবরদস্তি করেন নি । করলে রাজানুগ্রহ পাওয়ার আশায় রাজধানী দিল্লির আশেপাশে মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকত পূর্ব ও পশ্চিমের চেয়ে বেশি। দিল্লীর বাদশাহরা বরং স্থানীয়দের ধর্ম বিশ্বাসকে সম্মান করে তাদের সহযোগিতা নিয়ে শাসন কার্য চালিয়ে গেছেন । তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই জোর করে ধর্মান্তকরণ না করার জন্য।
কিছু জিনিস জেনে রাখা ভালো।
১, ইরানের নাদির শাহ কর্তৃক মোঘল ভারত আক্রমণ ও লুটতরাজ , ময়ূর সিংহাসন নিয়ে যাওয়া, এরপর হতে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য দুর্বল হতে শুরু করে।
২, স্পেন ও বলকান অঞ্চল মুসলিম শাসনাধীনে আসার পর অটোমেন সাম্রাজ্যের পতন হলে, ওসব অঞ্চল হতে মুসলিমদের ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন করা হয়।
৩, বর্তমান ভারতের শাসকবর্গ স্পেন বা বলকানদের মত নিষ্ঠুর হত তবে ভারত অনেক আগেই মুসলিম শূন্য হয়ে যেত। বিশেষত: ব্যর্থ সিপাহী বিপ্লবের পর।
৫, যে সকল জাতি কিতাবি অর্থাৎ যাদের নিজস্ব ধর্মীয় কিতাব ছিল তাদের ভিতরে ধর্মান্তকরণ খুবই কম হয়েছে। ভারতের উচ্চবর্ণের হিন্দু, ইউরোপের খ্রিস্টান ও চীন জাপানের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের নিজস্ব ধর্মীয় কিতাব থাকায় বাহিরের কোন ধর্ম তাদের খুব বেশি বিশ্বাসচ্যুত করতে পারেনি।
৬, ব্যাপক ধর্মান্তকরণ হয়েছে মূলত যাদের ধর্ম কিতাব ছিল না এমন জনগোষ্ঠী, উপজাতি, আদিবাসী , আফ্রিকা , মধ্যপ্রাচ্যে ও অন্য ধর্মে যাদের অচ্ছুৎ ভাবা হতো সেসব অঞ্চলে ।
৭, সবশেষে বলব, ভারত , স্পেন বা বলকান অঞ্চলে মুসলিম শাসন থাকার পরও ইসলাম ব্যাপক প্রসার লাভ করেনি তার মূল কারণ স্থানীয়দের ধর্ম বিশ্বাস । একই কারণে খ্রিস্টান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর জনগন মুসলিমদের শাসনে কোন নতুনত্ব অনুভব করেন নি । বরং ইসলামী সুফীবাদ ও পীর আউলিয়াদের প্রভাবে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে । খ্রিস্টানদের মত অসুস্থ মানুষের জন্য সেবামূলক মিশনারি কর্মকান্ড ইসলামে কোন কালে ছিলোনা। সেজন্যই সারা বিশ্বে খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী সর্বাধিক।
ধন্যবাদ। ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।
মন্তব্যসমূহ