ইরান এবং ইজরায়েল সরাসরি যুদ্ধ করছে না কেন?
অতীতে ইরান ও ইসরাইল প্রায় ৩০ বছরের জন্য সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিল, কিন্তু ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে তারা শত্রু রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। অথচ ১৯৪৮ সালে ইস্রায়েলের স্বাধীনতার পরে, যখন ইরাক সরকার ইহুদি নাগরিকদের উপর অত্যাচার শুরু করেছিল তখন ইরান তাদের আশ্রয় দিয়েছিল।
১৯৫০ সালে ইরান দ্বিতীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে (তুরস্ক প্রথম) ইস্রায়েলকে সরকারি স্বীকৃতি দেয়, যা এক দশক পরে প্রকাশ করে । সোভিয়েত আগ্রাসন প্রতিহত করতে ইরান সে সময় ইসরাইলের ইহুদি কমিউনিটির সহায়তায় আমেরিকা হতে অস্ত্র সাহায্য পেত।
ইরান ইরাক যুদ্ধের সময়, ইসরায়েল ছিল ইরানকে সামরিক সরঞ্জামের অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী। ইসরায়েল যুদ্ধের সময় সামরিক প্রশিক্ষক এবং ইরানের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সরাসরি সহায়তা প্রদান করে। যখন ইসরায়েল ইরাকের ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লিতে বোমাবর্ষণ ও ধ্বংস করে, অপারেশন অপেরার সময়, ইরানিরা ইসরায়েল এর বন্ধু ছিল ।
১৯৫০ সালের দিকে সোভিয়েত অনুসৃত "প্যান আরব" আন্দোলনে ইরাক, মিশর ইসরাইলের বিরুদ্ধাচারণ করলেও ইরান ইসরাইল কে সমর্থন করে।
প্যান আরব ইউনিয়ন |
তাদের বর্তমান দ্বন্দ্বের মূল কারণ আয়াতুল্লাহ খোমেনী, চরম ইহুদি বিদ্বেষী মানুষটি। যিনি ইসলামি বিপ্লবের পর ফ্রান্স থেকে ফিরে এসেই ইরানের ইসরাইলি দূতাবাস কে প্যালেস্টাইন দূতাবাস ঘোষণা করেন। আবার ইরাকের সাথে ইরানের দশ বছর মেয়াদি যুদ্ধে , ইরান ইসরায়েল থেকে গোপনে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ক্রয় করে যা তেল দিয়ে পরিশোধ করে ১৯৮৩ সালে।
১৯৮৫ সালে কুখ্যাত "ইরান-কনট্রা চুক্তি" , অন্যতম চক্রান্ত ছিল যার মাধ্যমে ইস্রায়েলের নিজস্ব পুরানো আমেরিকান মেয়াদ উত্তীর্ণ অস্ত্র ইরানের কাছে বিক্রি করা হয় এবং প্রাপ্ত অর্থ হস্তান্তর করা হয়েছিল নিকারাগুয়ায় সমাজতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করা বিপ্লবীদের কাছে।
ইরান-ইস্রায়েল দ্বন্দ্বের কারনঃ
ভারতের সাথে পাকিস্তান ও চীনের দ্বন্দ্ব মূলত সীমান্ত নিয়ে। কিন্তু সীমানা-দ্বন্দ্ব না থাকা সত্বেও ইসরাইল ও ইরানের বৈরিতা কেন চরমে তা ব্যাপক রহস্যের জন্ম দেয়।
বর্তমানে ইরান ও ইসরাইল যুদ্ধ অনিবার্য মনে হচ্ছে। কারন,
- ট্রাম্প ইরান-পাঁচদেশ পারমাণবিক চুক্তিকে সমাহিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। যা বাইডেন পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে।
- >নেতানিয়াহুর পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য ‘ইরান মিথ্যাবাদী’ এই বক্তব্য সমস্যা জিইয়ে রেখেছে।
- ইসরাইলের উদ্দেশ্য ইরানকে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হতে বাধা দেয়া।
ইরানের পরমাণু বোমা বহনকারী ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ভেদ করে আঘাত হানলে, ইহুদি রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।
ইরানকে বিরত রাখতে পরমাণু বিজ্ঞানিদের মেরে ফেলা একটি সফল প্রজেক্ট। ইরানে একসময় সেন্টরিফিউজ মেশিন চালানোর মত কেউ থাকবে না, তা যতই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করুক ।
ইহুদিদের স্বপ্নের " ল্যান্ড অব প্রমিজ" বলে যে বৃহত্তর ইসরাইল এর কথা বলা হয়েছে (ঈশ্বর বা যিহোবা কর্তৃক তাদের বর্গা দেয়া জায়গা) সেখানে কিন্তু ইরান নেই। তাহলে দ্বন্দ্বটা অন্য জায়গায়!
কাল্পনিক বৃহত্তর ইসরাইল রাষ্ট্র! |
ইরানের সাথে দ্বন্দ্ব মুলত ইসরাইল এর নিজস্ব আত্মরক্ষার প্রয়োজনে। ১৯৬৭ সালের মানচিত্র অনুযায়ী একটি স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে এই দ্বন্দ্ব হ্রাস পায় কিন্তু উগ্রপন্থী ইহুদীরা বৃহত্তর ইসরাইলের স্বপ্ন কখনোই বলি দেবে না, যে কারনে শান্তি চুক্তির মাত্র কয়েকদিন আগে এরিয়েল শ্যারনের মত কট্টর নেতাকেও হত্যাকে করা হয়েছিল।
কিন্তু ইরান কেন ইসরাইলের সাথে দ্বন্দ্বে যাচ্ছে?
১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং সাদ্দাম হুসেনের পরাজয়ের সাথে সাথে তেল সমৃদ্ধ ইরানের প্রধান হুমকি হল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র । আমেরিকা সৌদিদের সাথে বন্ধুত্ব পূর্ণ আচরণ করলে, তখন ইরান সৌদি আরবকে ও শত্রু বানিয়ে নিতে বাধ্য হয় । সৌদি আরব সে সেসময় ইরানের পরমানু অস্ত্রের বিরোধিতা করলেও এখন সেটার গুরুত্ব অনুধাবন করেছে। ইরানের মাধ্যমেই গোপনে চীনের সাথে সৌদিরা পরমাণু অস্ত্র তৈরির কর্মসূচি নিয়েছে, এর বিনিময় মূল্য হিসেবে সৌদিরা চীনের নিকট তেলের মূল্য ইউয়ান দ্বারা পরিশোধ করবে। বিশ্বে চীনের মুদ্রা শক্তিশালী হবে, যে সুবিধা এতদিন সৌদিরা শুধু ডলার কেই দিয়েছিলো।
মৌলবাদী দলগুলোর ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে কাল্পনিক শত্রু সৃষ্টি করে জনতাকে সেদিকেই ব্যস্ত রাখতে হয়। ইরানের মতে - আমেরিকা "গ্রেট শয়তান" - ও তার আঞ্চলিক মিত্র "ছোট্ট শয়তান" (ইস্রায়েল)। একই কায়দায় ভারতের মৌলবাদী দল বিজেপি পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও চীনের বিরুদ্ধেচারণ করে নিজেদের দেশবন্ধু হিসেবে প্রমানের চেষ্টা করছে। এটি মৌলবাদী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী ইসরায়েলের ও টিকে থাকার কৌশল।
খোমেনির ইরান দীর্ঘদিন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা খেয়ে জনগণের মৌলিক চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে দেশে তরুণদের মাঝে "এন্টি জায়নিস্ট " ইস্যু তুলতে পেরে তারা খুশি। এর ফলে ইস্রায়েলের সীমান্তে তারা প্রক্সি যুদ্ধ তৈরি করেছে। যুদ্ধের খরচ চালাতে গিয়ে ইরানের আর্থিক দৈন্যদশা বেরিয়ে পড়ছে। চীনের কাছে বেজায় সস্তায় তেল বিক্রি করছে ।
ইহুদি রাষ্ট্রের সাথে আপোষহীন ইমেজ তুলে র্যাডিকাল-ইসলামপন্থী আদর্শকে কাজে লাগাচ্ছে তারা । তরুণরা ইসরাইল বিরোধী আদর্শ খুব পছন্দ করে! এটাই ইরান সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু সরাসরি যুদ্ধের ক্ষমতা দীর্ঘ মেয়াদে ইরানের নেই। কট্টর এই দেশটিতে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা "মোসাদ " খুব নিখুঁত ভাবে কাজ করে চলেছে। ইরানি জেনারেল ও বিজ্ঞানীদের হত্যায় যে প্রযুক্তি তারা ব্যবহার করছে, দীর্ঘদিন অবরোধে থাকায় ইরান সে প্রযুক্তির মোকাবেলায় ব্যর্থ হচ্ছে।
তাই যে কোন সময় মোল্লা ওমর ও সাদ্দাম হোসেনের মত খোমেনী গং উৎখাত হয়ে যেতে পারে । ইয়েমেন, সিরিয়া ও লেবাননের শিয়া প্রভাব কাজে লাগিয়ে প্রক্সি যুদ্ধই সম্বল তার। কিন্তু ইসরায়েলের সাথে আসল যুদ্ধে যাওয়ার মতো যথেষ্ট সামরিক শক্তি ইরানের নেই। ইসরায়েল থেকে উড়ে আসা ক্ষেপনাস্ত্র আটকানোর জন্যে রাশিয়ার S৪০০ ক্ষেপনাস্ত্র বিধ্বংশী প্রযুক্তি এখনও কেনার মত সামর্থ্য ইরানের হয়নি। যদিও রাশিয়া ইরানের বন্ধু!
ইরান-ইসরায়েল প্রক্সি যুদ্ধ
সুত্র, আল জাজিরা,
মন্তব্যসমূহ