পাকিস্তান কী মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে পারবে?

পাকিস্তান কী মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে পারবে?


মুসলমানরা এখনো খিলাফতের প্রতি গভীর টান অনুভব করে। প্রায় ১২০০ বছর মুসলিমদের মানসিক 'ক্ষমতার উত্তরাধিকার' ছিল সেটা।


খালফ মানে সন্তান বা উত্তরাধিকার, সেটা হতে খলিফা হয়েছে, মানে, যিনি তার পূর্বের উত্তরাধিকারী হন।


নবীরাও যারা অন্যের (পূর্বের নবীর ) খুলাফা ছিলেন, আদম থেকে মোহাম্মদ ( সা: ) পর্যন্ত। কিন্তু ১ হাজার বছরের বেশি হতে চলল, মুসলিমরা মানসিক উত্তরাধিকার (খলিফা) বিহীন!


১৯২৪ সালে, তুরস্ককে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করার এবং অটোমান সাম্রাজ্যের কমান্ডার মোস্তফা কামাল পাশা খিলাফতের শতাব্দীকালের অফিস বাতিল করে দিয়েছিলেন।


সর্বশেষ অটোমান খলিফা কামাল পাশা কেবল প্রজাতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা প্রকল্প চালু করেননি, তিনি মুসলিম নেতৃবৃন্দ এবং রাজতন্ত্রীদের মধ্যে মুসলিম বিশ্বের নতুন নেতা হিসাবে স্বীকৃতি পেতে এরদোয়ানের মত দৌড়ঝাঁপও করেছিলেন।


কিন্তু একজন খলিফা যে কতবড় প্রয়োজন ছিল, তা আজ মুসলিম বিশ্ব হাড়ে হাড়ে অনুভব করছে, সেটি কিয়ামত পর্যন্ত অনুভব করতেই থাকবে।


বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন মুসলিম গোষ্ঠী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপীয় শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল।


কিন্তু অটোমানদের পরাজয়ের পরে অনেক মুসলিম রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবী কামালের ক্ষমতায় আসার প্রশংসা করেছিলেন এবং তাকে আধুনিক মুক্তিদাতা হিসাবে দেখেছিলেন।


খিলাফতের ধারণাটি মুসলমানদের মনে গভীরভাবে অন্তর্ভুক্ত বলে কামাল সচেতন ছিলেন। কামাল আসলে নিজেকে নতুন খলিফা হিসাবে নাম রাখতে চেয়েছিলেন।


তবে যেহেতু এটি তার ধর্মনিরপেক্ষতা এবং প্রজাতন্ত্রের প্রকল্পের বিরোধী তাই তিনি করেননি। তবে তিনি খিলাফতের এক দুর্বল সংস্করণ দিয়েছিলেন যা তুরস্কের বর্তমান শাসক এরদোয়ানরা নেতৃত্ব দেয়ার চেষ্টা করছেন মাত্র।


খিলাফত পুনঃ বহালের চেষ্টা

কিন্তু ১৯২৪ সালে অটোমান খিলাফতের বিলুপ্তির পরেই দু'জন প্রার্থী খিলাফত দাবী করার জন্য ছুটে গিয়েছিলেন।


মিশরের রাজা ফুয়াদ (এটি তখনও ব্রিটিশদের অধীনে ছিল! ) এবং ‘ওহাবী’ আরব উপজাতি নেতা, ইবনে সৌদ, যিনি ব্রিটিশদের সহায়তায় প্রাক্তন অটোমান অঞ্চল জয় করেছিলেন যা ১৯৩২ সালে সৌদি আরব হয়ে উঠে।


অর্থাৎ তখন সৌদি আরব ও রাষ্ট্র হয়ে ওঠেনি। মজার বিষয় ১৯৪৭ সালে, এই দৌড়ে আরও অনেক ছোট খেলোয়াড়ের উত্থান হয়েছিল। পাকিস্তান বলে অভিহিত নতুন একটি দেশ ।


পাকিস্তানের জন্ম

পাকিস্তানের স্বপ্নদৃষ্টা মুহাম্মদ ইকবালের কল্পিত পাকিস্তানের সাথে বাড়তি হিসেবে পূর্ব বাংলা কে ও পেয়েছিল দেশটি, যার মর্যাদা তারা দিতে পারেনি।


ব্রিটিশ ভারতের সম্পদ ও সম্পত্তি ভারতকে দেওয়া হয়েছিল, পাকিস্তানের জন্য ছিল শুধু জন্যসংখ্যা ও ধর্ম। পাকিস্তানের টিকে থাকাটাই ঝুলন্ত ভারসাম্য ছিল যা এখনো ঝুলে আছে বলে মনে হচ্ছে।


মুখে মদিনা সনদের কথা বললেও ইসলামকে বোঝার জন্য এটি ‘আধুনিকতাবাদী’ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছিল।


কিন্তু এরপরে মদিনা সনদ নিম্নমুখী হয়ে মুসলিম জাতীয়তাবাদ হিসাবে অগ্রসর হয়েছিল যা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ হিসাবে পুনঃনির্মাণ করা হয়েছিল এবং অদ্যাবধি তাইই চলছে।


কালক্রমে সেই পাকিস্তান অন্যদের ডিঙিয়ে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়ে উঠল।


সাম্প্রতিক মুসলিম বিশ্ব:

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে গুলিবর্ষণ এর ঘটনার দুদিন পরে তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট তথায় সফর করেন ও সেখানকার মুসলিম জনতার প্রতি সহমর্মিতা পোষণ করেন।


এ ঘটনা শুধু একটি সফর নয় তারচেয়েও বেশি কিছু, যা ভীত মুসলিম সমাজকে সাহস যোগানোর উদ্যোগ । তুরস্ক পারমাণবিক শক্তির অধিকারী না হলেও স্বভাবজাত নেতৃত্বগুন তাদের রয়েছে যা অটোম্যান সাম্রাজ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়।


পঞ্চদশ শতকে এই তুর্কিরা যখন ইউরোপের দ্বার ভিয়েনায় হাজির হয় , তখন খ্রিস্টান ইউরোপের নেতৃত্ব ত্রিধা বিভক্ত ছিল ফ্রান্স, স্পেন আর রোমানদের মাঝে। ফলে ভিয়েনার দখল নিতে সুলতান সুলেমানকে তেমন বেগ পেতে হয়নি। আজ মুসলিম বিশ্বের ঠিক তেমনি অবস্থা।


সৌদি, ইরান, তুর্কি ইস্যুতে বিভক্ত মুসলিম উম্মাহ। এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র তার ছড়ি ঘুড়াচ্ছে মুসলিমদের মুখের উপর। সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে যাকে তাকে ঘায়েল করছে। অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলকে আরবদের মিত্র বানানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।


পাকিস্তানের ভূমিকা:

সম্প্রতি পাকিস্তানের "ডন" পত্রিকা এমনি এক বিষয়ের অবতারণা করেছে প্রশ্নকর্তার আদলে। নেতৃত্বহীন মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব দিতে পাকিস্তানের সামনে নাকি সুবর্ন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে ! এর পক্ষে আছে তিনটি যুক্তি,


১, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যা


২, মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তম সেনাবাহিনী ও


৩, পারমাণবিক বোমা।


অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও বড় সেনাবাহিনী পজিটিভ কোন অর্থনৈতিক ফ্যাক্টর ত নয় বরং দেশের জন্য বোঝা আর মুসলিম বিশ্বের এই বৃহত্তম সেনাবাহিনী ভারতের সাথে যুদ্ধে দুইবার ও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর কাছে একবার শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়েছে।


পাকিস্তানের টিকে থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন নিরাপত্তা স্বার্থ। অভ্যন্তরীণ নৈরাজ্য বা একটি ইসলামী বিপ্লব বা পাকিস্তানের পতন, ইসলামী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রচারকে পঙ্গু করে দেবে।


পাকিস্তান রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করা এবং একইসাথে পশ্চিমাদের সাথে এর সহযোগিতা সীমাবদ্ধ করা ওয়াশিংটনের পক্ষে অতীব গুরুত্বপূর্ণ।


সেসময় মিত্র হওয়ার কারণে পাকিস্তানের পরমানু ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ইরানের পরমানু ইস্যুর মত "অবরোধ-যুদ্ধ" করেনি।


পাকিস্তান নেতৃত্ব দিলে কি উপকার হইবে মুসলিম বিশ্বের তাহা একটু বিশ্লেষণ করা যাক:

সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ভারতের বন্ধুত্বের সুবাদে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের বন্ধুত্ব মুসলিম বিশ্বের কোন কল্যানে আসেনি, যেমনটি আসেনি সৌদীদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বে।


এত বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব করে , তাদের থেকে কোটি কোটি ডলারের অস্ত্র কিনেও সৌদিরা ফিলিস্তিনিদের জন্য কোন সুখবর বয়ে আনতে পারেনি।


বরঞ্চ পাকিস্তান ও সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু হলেও বিভিন্ন সময় শুধুই অস্ত্র ক্রেতা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ইরাক আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্রকে সৌদীদের সহায়তা কিংবা আফগানিস্তান আক্রমণে পাকিস্তানিদের ভূমিকা বন্ধুত্বের নয় , অনেকটা আজ্ঞাবহ ভৃত্যের।


ইয়েমেনে সৌদি হামলার কারনে মুসলিম বিশ্বে সৌদি শাসকদের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায়।


পাকিস্তানের সাথে চীনের বহুদিনের বন্ধুত্ব। কিন্তু এই বন্ধুত্ব যদি রোহিঙ্গা বা উইঘুরদের দুর্দশা মোচনে কিঞ্চিৎ কাজ করতো তবে বিশ্ব মুসলিম জানতো পাকিস্তান নিজের পেট পূর্তি ছাড়াও বিশ্ব মুসলিমদের জন্য ভাবিত।


দেশটির সেনাবাহিনীর গণহত্যার অভিযোগ আছে, তাদের কোন নেতৃত্ব গুন নেই তবে ইমরান খাঁনের নেতৃত্ব গুন আছে।


দুর্বল পাকিস্তান কে বিশ্বকাপ জেতানোর ম্যাচগুলোতে আমরা দেখেছি । নিজের তৈরি তেহরিক ই ইনসাফ নামক নতুন এক রাজনৈতিক দল থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া, ক্যানসার হাসপাতাল তৈরি করা, ধৃত ভারতীয় পাইলটকে ফেরত দেয়া, প্রভৃতি কাজে নেতৃত্বগুন ই তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে।


বিশ্বের ৫০ শীর্ষস্থানীয় জনপ্রিয় মুসলিম নেতাদের মধ্যে এরদোগান, মোহাম্মদ বিন সালমান, জর্দানের আব্দুল্লাহ অন্যতম। ইমরান খানের অবস্থান সেখানে ২৯ তম।


কিন্তু তিনি এই নেতৃত্বগুন কাজে লাগাতে চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি ওআইসি নাইজারে শীর্ষ বৈঠকে ভারত কর্তৃক কাশ্মীরের অধিকার লুন্ঠন করার নিন্দা করেছে।


যে পাকিস্তান নিজ দেশের পূর্ব অংশের মানুষের সাথে বেইমানি করেছে, সেখানে গণহত্যা করেছে, তাদের নেতারা যে ( ভুট্টো কিংবা আর্মি গং যেই হোক) অতি হীন মানসিকতার অনুসারী তা প্রমাণিত। বাংলাদেশ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো হতে পাকিস্তান কখনোই সমর্থন পাবেনা।


প্রতিবেশী ভারত কে মোকাবেলা করতে চীন থেকে প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করেছে ও পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়েছে তারা।


কিন্তু তাদের থেকে অর্থনৈতিক অগ্রগতি তে ভারত অনেক এগিয়ে গিয়েছে, পাকিস্তান থেকে দেড় গুণের ও বেশি মাথা পিছু আয় ভারতের।


অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া পাকিস্তানের পক্ষে মার্কিন, চীন ও সৌদি বলয় ছেড়ে আসা সম্ভবও নয়।


গত মাসের শেষ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান উড্রো উইলসন সেন্টারের আয়োজনে পাকিস্তান নিয়ে এক অনলাইন আলোচনায় সেদেশের প্রখ্যাত নিরাপত্তা বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ‘সৌদি আরব দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের স্বার্থকে নতুন করে পর্যালোচনা করছে এবং পাকিস্তানের চাইতে ভারত তাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।


সেই সঙ্গে ইরান এখন পাকিস্তানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চিত্র, মুসলিম দেশগুলোর জনমত জরিপে নেতৃত্ব দানে সক্ষম দেশগুলোর শীর্ষে আছে তুরস্ক।


কিন্তু ইরান-চীন বলয়ে থেকেও মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব নয় পাকিস্তানের পক্ষে। তাই নেতৃত্বের দৌড়ে তুরস্ক, সৌদীদের অনেক পেছনে পাকিস্তানের অবস্থান।


অদূর ভবিষ্যতে ও তাদের সে সম্ভাবনা নেই। সন্ত্রাস ছেড়ে প্রতিবেশীর চেয়ে অর্থনীতি ও রাজনীতিতে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া পাকিস্তানের আর কোন বিকল্পও নেই।


খিলাফত কী এখনো প্রয়োজন!


»Next


ধন্যবাদ পড়ার জন্য। স্বাস্থ্যের কথা/ অনলাইন স্বাস্থ্য ম্যাগাজিন


মন্তব্যসমূহ